আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন সাদা প্লাস্টিকের বক্স/কন্টেইনারে করে হাফ লিটার, এক লিটার কিংবা দুই লিটার পোলার আইসক্রিম পাওয়া যেত। এখনো এ ধরণের কন্টেইনারেই আইসক্রিম বিক্রী হয়--এ ব্যপারটার ক্ষেত্রে সময় যেন থেমে রয়েছে।
তবে সে যুগে ফ্লেভার ছিল মাত্র অল্প কয়েকটা; ভ্যানিলা, চকলেট এবং ম্যাংগো --এখনের মত এত বাহারী সব ফ্লেভার আর কম্বিনেশান (বাটারস্কচ, ব্লুবেরি চিজকেক, ইত্যাদি) তখন ছিল না। অল্পদিন পরে ইগলু আইসক্রিম এসে আরো কিছু নতুন ধরণের আইসক্রিম এনেছিল বাজারে।
একদিন স্কুল থেকে বাসায় এসে দেখি আমাদের পরিবারের জ্যেষ্ঠ চাচাতো ভাই এবং সর্ব কনিষ্ঠ চাচা একটি লেবেলবিহীন আইসক্রিমের কনটেইনার নিয়ে বারান্দার দিকে ধাবিত হচ্ছেন।
প্রথমে ভাবলাম বারান্দায় গিয়ে দাদুর চোখ এড়িয়ে, চুরি করে আইসক্রিম খাওয়া হবে। চামচ নিয়ে আসবো কি না জিজ্ঞেস করতে করতে দুইজনে বারান্দায় ঢুকে গেল।
বারান্দার ঝকঝকে তকতকে মেঝেতে এক চিলতে রোদ দেখতে পেলাম। তখন সম্ভবত শীতকাল আসি আসি করছে।
এখন আমি যে বাসায় থাকি, সেখানে বারান্দাই নেই। কোন এক সুন্দর দিনে, ঘরের আয়তন বাড়ানোর উদ্দেশ্যে মর্মান্তিকভাবে বারান্দার সিমানা সূচক দেয়ালখানা মিস্ত্রীদের সহায়তায় উড়িয়ে দিয়েছিলাম।
সেখানে অনেকগুলো ফুলের টব ছিল, আর উপরে দড়িতে ভেজা কাপড় শুকোতে দেয়া ছিল। সবগুলো কাপড় প্লাস্টিকের ক্লিপ দিয়ে আটকানো ছিল এবং বাইরে থেকে মৃদুমন্দ বাতাস আসছিল।
ইতিমধ্যে মেঝেতে একটি চার কোণা বোর্ড বিছানো হয়েছে। অবাক হয়ে দেখলাম যে আইসক্রিমের কন্টেইনার থেকে আইসক্রিমের পরিবর্তে এক গাদা সাদা ও কালো গুটি বের হয়েছে। গুটিগুলোকে সাজানো হলো বোর্ডের দুই মাথায়। জ্যেষ্ঠ কাজিন এবং কনিষ্ঠ চাচা গুটিগুলো নিয়ে এক ধরণের খেলায় মেতে উঠলো, আর আমরা বাকিরা (এক দঙ্গল কাজিন) বসে মন্ত্রমুগ্ধের মত সেই খেলা দেখতে থাকলাম।
খুব অল্প সময়েই আমরা শিখে গেলাম খেলাটা। এরপর রাতদিন চলতে লাগলো দাবা খেলা। যখনই কেউ ফ্রি হচ্ছি, তখনই অন্য আরেকজন কাজিনকে খুঁজে নিয়ে বসে যেতান খেলতে। বড়দের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরণের "প্রথম চাল" শিখতাম। অনেক পরে জানতে পেরেছি যে এগুলোকে বলে "ওপেনিং স্ট্র্যাটেজি"।
একদিন সাদা নিয়ে খেলছিলাম আমি, আর যথারীতি প্রথম চালে একটি সৈন্য (ইংরেজিতে pawn) কে সামনে এগিয়ে দিলাম। এরপর, ছোট চাচা সৈন্য না বের করে সরাসরি ঘোড়া (knight) চেলে বসলেন। আমার মুখ হা হয়ে গেল!
প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল "সৈন্য ছাড়া প্রথম চাল দেয়া যায় না"। কিন্তু উনি আমাকে বুঝালেন যে এটা সত্য নয়, এবং তিনি যা করেছেন তা হচ্ছে "আলেখাইন ডিফেন্স"।
এই কথাটি মাথার উপর দিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এর বহু বছর পর গুগল করে জেনে নিয়েছিলাম যে হ্যা, আসলেই এটি এক ধরণের ওপেনিং।
দাবা খেলা নিয়ে রয়েছে অনেক মজার মজার স্মৃতি। কাজিনদের মধ্যে আমি সেরা খেলোয়াড় ছিলাম না, কিন্তু খুব খারাপও খেলতাম না। খেলা শেখার পর থেকে ছাত্র জীবন শেষ করার আগে পর্যন্ত অসংখ্য ম্যাচ খেলেছি, অনেক মানুষের সাথে। কলেজের চেস ক্লাবের সদস্যও হয়েছিলাম।
একটা সময় ছিল যখন বাসায় কোন মেহমান আসলে তাকেও দাবা খেলার প্রস্তাব দিয়ে বসতাম। দাওয়াতের আয়োজন থাকলে মনে মনে প্রত্যাশা করতাম যে মেহমানদের মধ্যে অন্তত একজন যেন দাবা খেলা জানা মানুষ থাকে।
পরবর্তীতে অন্যান্য খেলা এসে আস্তে আস্তে দাবার আকর্ষণকে কমিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু আজও হাতের সামনে দাবার বোর্ড দেখলে খেলার জন্য হাত নিশপিশ করে।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, শেষ কবে একটি দাবার বোর্ড ও গুটি আমার চোখের সামনে দেখেছি, তা মনে করতে পারছি না। হ্যা, মোবাইলের এপ দিয়ে দাবা খেলা যায়, কিন্তু সে খেলা কি আর সামনাসামনি বসে, প্রতিপক্ষের চোখের ভাষা বুঝতে বুঝতে খেলার আনন্দ দেয়?
কিছু জিনিস আর কখনোই আমাদের জীবনে ফিরে আসবে না, এই ব্যাপারটার সাথে মানিয়ে নেয়া কঠিন।
#নস্টালজিয়া
পর্ব ৪ঃ দাবার বোর্ড
ছবি ক্রেডিটঃ Getty Images
No comments:
Post a Comment