সে যাই হোক। আমি ঐ স্কুলে ভর্তি হই পঞ্চম শ্রেণীতে। এস এস সি পরীক্ষা দেয়া পর্যন্ত অনেক স্মৃতি। তার মাঝে বিশেষ একটি স্মৃতির কথা আজকে বলতে চাই।
তখন বোধহয় ষষ্ঠ কি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। সেসময় সারা দেশ জুড়ে শুরু হয় একটি বিশেষ প্রতিযোগিতা, যা বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র থেকে পরিচালিত হয়েছিল।
প্রতিযোগিতার রুপরেখাটি খুবই সহজ ছিল। সব অংশগ্রহণকারীকে একটি করে বই পড়তে হবে, আর সেই বই এর উপর ভিত্তি করে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আমাদের ক্লাশ টিচার জানালেন যে যে অংশ নিতে চায়, তারা যেন ক্লাশ ক্যাপ্টেন এর কাছে নাম জমা দেয়।
সেই বয়সে আমি ছিলাম বই এর পোকা। অবশ্যই গল্পের বই। সারাক্ষণ ডুবে থাকতাম সেগুলো নিয়ে, এবং প্রায়শই "আউট বই" পড়ার জন্য উত্তম মধ্যম জুটতো বাবা মায়ের কাছ থেকে।
মনে মনে ভাবলাম, বৈধ উপায়ে যদি একটি নতুন গল্পের বই পড়া যায়, তাহলে সমস্যা কি? জমা দিলাম নাম।
বাসায় এসে "স্কুল থেকে বলসে অংশ নিতেই হবে" জাতীয় কথাবার্তা বলে আম্মা কে বুঝালাম। আম্মা, আব্বার কাছ থেকে ছাড়পত্র আদায় করলো। ত্রিশ টাকা দিয়ে কিনলাম চার্লস ডিকেন্স এর অমর উপন্যাস "Great Expectaions" এর বংগানুবাদ, যার নাম ছিল "বড় আশা করে"।
যেহেতু এই বই এর উপর একটা পরীক্ষা দিতে হবে, আম্মা আমাকে বাধ্য করলেন বইটি একাধিকবার পড়তে। একবার, দুইবার করে মনে হয় সাত আট বার পড়ে ফেলেছিলাম বইখানা।
সেই বই এর প্রতিটি শব্দ যেন এখনো কানে বাজে। চোখ বুজলেই দেখতে পাই শিশু পিপ এর ক্রিসমাসের রাতে রান্নাঘর থেকে খাবার চুরি করার দৃশ্য--একটা আস্ত মুরগীর রোস্ট, মদ, বড় এক টুকরো পাউরুটি, ইত্যাদি নিয়ে সে সন্তর্পণে, পা টিপে টিপে হাটছে। একটি জগে রাখা মদ থেকে বোতলে ঢেলে নিয়ে, সেই জগে আবার পানি ঢেলে রাখা। সব কিছুই হচ্ছে অন্ধকারে। তারপর মদের বদলে ক্যাস্টর ওয়েল খেয়ে আংকেল পাম্বলচুক এর জোরে জোরে কাশি সহ বিষম খাওয়া। পরবর্তী তে এস্টেলার আগমন। থাক, আর না বলি।
পরীক্ষার অল্প কিছুদিন আগে জানলাম যে স্কুল পর্যায়ের বিজয়ীরা জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় পর্বে অংশগ্রহণ করতে পারবে। সেখানে বিষয়বস্তু থাকবে "বাংলা সাহিত্য"। কিন্তু চমক এখানেই শেষ না, আমার প্রধান শিক্ষক এসেম্বলি তে ঘোষণা দিলেন যে নন্দিত ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদ স্যার স্কুল পর্যায়ে জয়ী হওয়া তিন জনকে আমাদের সুবিশাল অডিটোরিয়ামে নিজ হাতে পুরষ্কার তুলে দিবেন।
জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতা নিয়ে যদি আমার উচ্ছাস থাকে ১০ এ ৮, তাহলে হুমায়ুন আহমেদ স্যার কে স্বচক্ষে দেখা নিয়ে আমার উচ্ছাস ছিল ১০ এ ৩০! মনে মনে ঠিক করেছিলাম যে যদি জিততে নাও পারি, তাহলে অবশ্যই অন্তত উনাকে দেখার জন্য প্রথম সারিতে জায়গা নেয়ার চেষ্টা করবো।
যেদিন পরীক্ষার ফল ঘোষিত হল, নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি কিভাবে জানি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ফেললাম।
দেখতে দেখতে সেই স্বপ্নের দিন চলে এলো কাছে। মনে মনে অনেক ভেবে রেখেছিলাম যে স্যার কে জিজ্ঞেস করবোঃ
ফিহা কেন মারা গেলেন? উনাকে না মেরে চতুর্মাত্রিক সময় সমীকরণের সমাধান টা কোন ভাবে করা যেতো না?
বোতল ভুত বলে কি আসলেও কিছু আছে?
হিমু কি আসলে আপনি নিজেই?
মিসির আলীর জীবনের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ কোনটা?
হেড স্যার মাইকে আমার নামটা ডাকলেন, আর আমি দৌড়ানো আর হাটার মাঝামাঝি একটা পদ্ধতির মাধ্যমে স্টেজে উঠে গেলাম। চারদিক থেকে বন্ধুরা হাত তালি দিচ্ছিলো, দুই একজন পিঠও চাপড়ে দিলো, কিছুই আমি খেয়াল করছিলাম না। কেমন জানি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম।
খুব ভয়ে ভয়ে উনার হাত থেকে ক্রেস্ট টা নিলাম। কিছু ছবি উঠলো।
তারপর দেখি উনি মিটিমিটি হাসছেন। উনার সেই ট্রেডমার্ক হাসি। মোটা কাচের চশমার আড়ালে লুকনো গাম্ভীর্য। হাসি দেখে ভরসা পেলাম। হাত মেলানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম। খুব মোলায়েম হাতের ছোয়া। মনে যা প্রশ্ন ছিল সব ভুলে কিছু না বলেই ফিরে এলাম নিজের জায়গায়।
গতকাল ছিল শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আহমেদ স্যার এর প্রয়াণ দিবস। উনি লেখক হিসেবে সমালোচকদের কাছে প্রিয় হতে পারেন নি, অনেক বোদ্ধা উনাকে সাহিত্যিক বলতেও নারাজ। কেউ কেউ এমনও বলেন যে হুমায়ুন আহমেদ এর কারণে নাকি একটা জেনারেশন বই পড়া শিখেনি।
আমি এইসব নিন্দুক দের বিশুদ্ধ্ব মুড়ি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানাই। ভালো থাকুক প্রিয় লেখক, যেখানেই আছেন। আপনার কারণেই আজকে আমরা পাঠক, লেখক। অনেক শ্রদ্ধা আপনার উদ্দেশ্যে।